আউট হাউসে খুন
রাজিত বন্দোপাধ্যায়।
* আবার জাহিদ গনাই
আমি ভেবেছিলাম আর বোধহয় জাহিদ গনাই এর বিষয় আমাকে উত্যক্ত করবে না । কাশ্মীর ছেড়ে এসেছি অনেক দিন হয়ে গিয়েছে । গুলফাম স্যার প্রায়ই ফোনে যোগাযোগ রেখে চলেছেন । তবে এখনও নাকি জাহিদ গনাই এর কোন খবর নেই । স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে লোকটা । কিন্তু আমার মন বলছে হতে পারে না । জাহিদ গনাই একা নয় , তার পিছনে যে একটা বিরাট দল কাজ করছে , কাশ্মীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সে সম্পর্কে আমাদের নিঃসংশয় করেছে । আশিকুর রহমান ও ডঃ নাজির আহমদের হত্যা আমাদের সামনে একটা বিরাট রহস্য জাল যেন টাঙ্গিয়ে দিয়েছে । গুলফাম স্যার আজও সেই জালের সন্ধানে কাজ করে চলেছেন। একবার তার নাগাল পেলে তিনি সেই দুই হত্যা রহস্যের কেন্দ্রে পৌঁছানোর আশা রাখেন ।
প্রায় ছয় মাস পরে আমি উপস্থিত হলাম ফের শ্রীনগরে । এপ্রিল শেষ হতে চলেছে। ঠান্ডা ততটা নয়। ফুলেরা যেন আরো ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাশ্মীরের শিরায় উপশিরায় । ডাল লেক যেন নববধূর সাজে বিভোর ! সেই পরিচিত কফি হাউসে আমি জানালার ধারে এক মগ ধূমায়িত কফি ও পেপার যোগে বসে । কাঁচের জানালায় বুলেভার্ডের অপর পারে ডাল লেকে শিকারার ভিড় । ঝকঝকে দুপুর ! বসে বসে পেপারে চোখ বুলাতে বুলাতে গুলফাম স্যারের অপেক্ষা করছিলাম হঠাৎ যেন মাটি ভেদ করে আমার টেবিলের সামনে এসে উদয় হলেন গুঁফে ভদ্রলোক । সারা মুখে উত্তেজনা । দেখলাম দেরী হবার জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে মাথার টুপি টেবিলে চটাস করে নামিয়ে রেখে , চেয়ার টেনে বসে পড়লেন দু পা ফাঁক করে । মুখে ঘন অন্ধকার !
ধূমায়িত কফি এল । উনি তাতে চুমুক পেড়ে হঠাৎ যেন সেটার স্বাদ জানানোর মত মুখ কুঁচকে বললেন ,
-- আজ ফির উসে পা কর ভী খো দিয়ে ।
আমি সপ্তম আশ্চর্য দেখার মত মুখ করে হাঁ করে শুধালুম ,
-- কিসকো গুলফাম স্যার ?
তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন ,
-- জাহিদ গনাই কো !
আমি এত জোরে চমক খেলুম যে আমার হাঁটু লেগে কফি টেবিলটা থর থর করে কেঁপে উঠল । খানিক চমকে থমকে আমি ফের প্রশ্ন করলাম ,
-- কাঁহা ?
উনি কফি মগে আরেকটা লম্বা চুমুক পেড়ে বললেন ,
-- জোহাঙ্গি চক কে রমজান বিল্ডিং মে ।
এরপর তিনি তা বললেন , তা এই রকমঃ স্পেশাল ব্রাঞ্চ বহুদিন ধরে লেগেছিল এক সাইবার ক্রাইমের পিছনে । কে বা কারা এর অপারেটর তা জানবার জন্য স্পেশাল ব্রাঞ্চ রাত দিন এক করে লেগেছিল । কেবল ভারতেই নয় , জার্মানী , অস্ট্রেলিয়া এমন কি সুদূর প্যান আমেরিকান দেশের লোকদেরও ঠকিয়ে তাদের একাউন্টের ডিটেলস যোগাড় করে টাকা লুঠে চলেছিল তারা । তাদের সুতো যে শ্রীনগরেও রয়েছে সি বি আই ও অর্থ দপ্তরের মাধ্যমে পুলিশের কাছে আসে । শেষে তা স্পেশাল ব্রাঞ্চকে তুলে দেওয়া হয় । এবং তারা অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে টাওয়ার বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে , রমজান বিল্ডিংয়ে এদের ডেন । তারই রেইডে যেয়ে হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় গনাইকে ।
গুলফাম স্যার হঠাৎ লিফট থেকে দেখেন একজন মারা ও দাড়ি কামানো মানুষ , তার এক কানে হীরের রিঙ পরা ! অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছেন বিল্ডিংয়ের শেষ প্রান্তের লিফটের দিকে । গুলফাম স্যার তৎক্ষণাৎ পিছু নেন । লোকটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে । এবং একটু তাড়াতাড়ি পা ফেলে তাঁকে পেরিয়ে গিয়ে একটা রুমের দরজায় থেমে যেতেই একেবারে মুখোমুখি দেখলেন , জাহিদ গনাই ! তার মুখ এত মনের গভীরে রয়েছে যে , লাখো মানুষের মধ্যেও তাকে চিনতে ভুল হবে না গুলফাম স্যারের। বিমূঢ়তা কাটিয়ে তিনি চিৎকার করতেই তাঁর অফিসারেরা ছুটে এলেন । তাঁরা দ্রুত নীচের দিকে দৌড় দিলেন সিঁড়ি ধরে । কিন্তু ততক্ষণে লিফটে নামা জাহিদ গনাই সদর গেট দিয়ে রাস্তায় পা রেখেছে । গুলফাম স্যার জিজ্ঞাসা করায় লিফট ম্যান জানালেন , মাথা কামানো একজনই এ বিল্ডিংয়ে রয়েছেন , তিনি জুনেইদ মাট্টু । অফিসাররা সমস্বরে বলে উঠলেন ,
-- আরে এহী তো ১৪ নম্বর কেবিন কী বস হ্যায় স্যার !
গুলফাম স্যার সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে আলগাবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের সংযোগে চমকে উঠলেন । এখন আবার নতুন ভাবে এই কেসের ভাবনা চিন্তা শুরু করতে হবে ।
* ই - মেলের আর্তি
পরের দিন যথারীতি আমরা এসে বসেছি বিকেলে কাফের রঙিন মহফিলে । সামনের কাঁচের জানালায় রঙীন ডাল লেক সহ বুলেভার্ড । ডাল ছাড়িয়ে ঘন সবুজ চিনারের প্রাচীর । আর তার ওপারে থাকা হালকা নীল হরিপর্বতের ল্যান্ড স্কেপ । যেন ছাপানো এক মস্ত চমৎকার রঙ বাহারি ক্যালেন্ডার । আমার সামনে ধূমায়িত কফি মগ হাতে গুলফাম স্যার । গোঁফের তল দিয়ে কফিতে চুমুক পাড়তে পাড়তে ফোনে আসা মেল খুলে পড়ছিলেন । পড়া শেষ করে ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিতে চমকালুম । নিয়ে দেখি তাতে যা ইংরেজীতে লেখা রয়েছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায় এই রকমঃ
আপনাকে বহুবার ফোনে ধরতে চেষ্টা করেছি , কিন্তু পারিনি । প্রতিবার আপনার অফিস আমায় বলেছে যে আপনি নেই । আপনার পার্সোনাল নম্বর আমার কাছে নেই । আমার এক বান্ধবী অনেক কষ্টে আপনার ই - মেল আইডিটি যোগাড় করে দিয়েছেন । তাই লিখতে পারছি । পত্রিকায় নিশ্চই পড়েছেন , জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন এখন আমার কাছে ঘটনাটা । আমি সশরীরে গিয়ে দেখা করতে পারছি না মায়ের জন্য । তাঁকে ছেড়ে যেতে পারছি না । প্লীজ এই মেল আইডিতে লিখুন অথবা টেলিফোন করুন এই নম্বরে ...
বিনোদ ডাকুয়ার কন্যা
অমৃতা ডাকুয়া।
গুলফাম স্যার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন , গোঁফের তল দিয়ে এক চুমুক কফি পান করে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম ,
-- শেপিয়ার পিনজুরা গ্রামের ঘটনা ।
গুলফাম স্যার কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে মাথা নাড়লেন । তারপর গম্ভীর স্বরে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন ,
-- আপ কা ক্যা খয়াল হ্যায় ব্যানার্জি ?
আমি নীরস কন্ঠে বললাম ,
-- আমার সঙ্গে শ্রীনগরে পৌঁছানোর রিপোর্ট করা সত্ত্বেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কেউ কোন যোগাযোগ যখন করেননি এখনো , তো হাতে কোন কাজ নেই । কাজে কাজেই যাওয়া যেতে পারে ।
হাতের কফি মগ টেবিলে নামিয়ে রেখে গুলফাম স্যার পকেট থেকে রুমাল বের করে গোঁফে লাগা কফি মুছে বললেন ,
-- হুম ! তব চলিয়ে ।
বলে উঠে পড়লেন । উঠলাম আমিও।
শোপিয়ার পিনজুরা গ্রামের আউট হাউসে পুড়ে জনৈক বিনোদ ডাকুয়ার রহস্যময় মৃত্যুর ব্যাপারটি আমার মনে খুব উৎসুকতা তৈরী করেছিল । নর্থবেঙ্গল ইউনিভার্সিটিতে যখন ক্রিমিনোলজি নিয়ে পড়াশুনা করছিলাম , হোস্টেলে আমার রুমমেট ছিল রমেন ডাকুয়া । ডাকুয়ারা উত্তরবঙ্গে বাস করা আদিম অধিবাসীদের একটি শাখা । ওদের সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য তখন আমি যোগাড় করেছিলুম মনে আছে । মেলে দেওয়া ফোন নম্বরে সঙ্গে সঙ্গে জানানো হল কাল সকালে আমরা আসছি পিনজুরা গ্রামে ।
গুলফাম স্যারের জিপসীতে হোটেলে ফিরেছিলুম কিছু গরম জামার প্রয়োজনে । হোটেল আদুসের গেট লাগোয়া ফুটপাতে থাকা একটা খবর কাগজের ভেন্ডর থেকে দু তিনটে সান্ধ্য খবর কাগজ ও দৈনিক খবরের কাগজ আমি কিনে নিলাম । তারপর এসে বসলাম আমার রুমে। খবর কাগজ ঘেঁটে ঘেঁটে যেটুকু তথ্য পেলুম তা মগজে বেশ গুছিয়ে ভরে রাখলুম । খবরের কাগজ গুলোতে যা প্রকাশ পেয়েছে সেই ঘটনাটা এই রকমঃ
শোপিয়া জেলা শহর থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে পিনজুরা গ্রামে এক অভূতপূর্ব দুঃখজনক ঘটনায় এক মারাত্মক হত্যার খবর পাওয়া গিয়েছে । গতকাল সন্ধ্যায় এক নির্জন আউট হাউসে হঠাৎ আগুন লেগে জ্বলে উঠতে দেখা যায় । এবং এই আগুন লাগার ঘটনাটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা বলে জানা গিয়েছে । গ্রামবাসীদের তৎপরতায় কোন রকমে সেই আউট হাউসের আগুন নিভানো সম্ভব হয় কাল রাতে । আজ সকালে সেই আগুনে পোড়া ঘরটি পুলিশ এসে পরীক্ষা করার সময় হঠাৎই পাওয়া যায় বিনোদ ডাকুয়া নামে জনৈক ব্যক্তির জ্বলে যাওয়া শরীরটি। বিনোদ ডাকুয়া সেই আউট হাউসের অনতি দূরেই থাকতেন । তিনি কিছুদিন হল এই অঞ্চলে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন । তিনি কাল সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ । এই আউট হাউসে আগুন লাগার কিছু সময় আগে তাঁকে ঐ দিকেই যেতে দেখা গিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে । আউট হাউস থেকে প্রাপ্ত লাশটির এতটাই জ্বলে গিয়েছে যে চিনবার উপায় নেই । তবে ভদ্রলোক আগুনে পুড়ে নয় , জানা যায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে । পুলিশের ডাক্তার দেখেছেন যে ভদ্রলোকের গলা বেশ গভীর ভাবে কাটা হয়েছে । কোন সন্দেহ নেই যে হত্যাকারী তাঁকে হত্যা করার পর সমস্ত প্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যে আউট হাউস সমেত লাশটিকে পুড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিল । পুলিশ সুদেশ বর্মন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে । এই ভদ্রলোক প্রায়শই মৃত বিনোদ ডাকুয়ার বাড়িতে আসতেন ।
আমার ভ্রূকুটি আরো গভীর হল । এই তথ্য থেকে কোন পথই খুঁজে পাওয়া মুশকিল , যতক্ষণ না স্পটে যেয়ে দেখে শুনে কথাবার্তা কওয়া যাচ্ছে । আমি উন্মুখ হলাম আগামী দিনের যাত্রা সম্পর্কে ।
* পিনজুরা গ্রামের সকাল
গুলফাম স্যারের জিপসী আমাদের দুজনকে নিয়ে শহর ছাড়ার আগেই আমি হোটেল আদুসের ফুটপাতের দোকান থেকে দু তিনটে দৈনিক কিনে নিলুম । সেটাই পড়তে শুরু করলুম শহর ছাড়িয়ে পথের পাশে গ্রাম আর চিনারের জঙ্গল শুরু হতেই । কিন্তু আর তেমন কোন নতুন খবর দিতে পারেনি সংবাদ পত্র গুলো । পাশে বসে ভীষণ গম্ভীর মুখে গুলফাম স্যার গভীর চিন্তায় মগ্ন ।
পর্দায় আড়াই ঘণ্টা চলবার পর আমরা একটা বেশ চকের মত জায়গায় পৌঁছে গেলাম । শোনা গেল এখান থেকে তিন কিমি উত্তরে মেটে রাস্তা ধরে গেলে পাওয়া যাবে পিনজুরা গ্রাম । অনেক খোঁজাখুঁজি করে এখানে একটা আউট পোস্ট পাওয়া গেল । সেখানের থানাদার একটা লম্বা স্যালুট মেরে বসল গুলফাম স্যারের পরিচয় পেয়ে । তিনিই শেষ পর্যন্ত একটা লোককে ধরে আনলেন পিনজুরা গ্রামের । এসেছিল বাজারে প্রয়োজনে । গ্রামে ফিরবার পথ ধরবে ধরবে করছিল । আমি তাকে পিছনে ডেকে বসালে গুলফাম স্যারের চোখে দুর্বোধ্যতর ছায়া দেখা গেল । তিনি কিছু না বলে সামনে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলেন । তাকে দেখে বোঝা গেল কানটা তিনি পিছনেই ফেলে রেখেছেন । তবে বুঝলুম , তিনি বুঝতে পেরেছেন যে এমন একজন গ্রামের তথ্য সরবরাহকারকের সাথে আমি কেন সহযাত্রী হতে এত বেশী ইচ্ছুক । তাই মুখ বন্ধ করে সামনের সীটে গিয়ে বসেছেন ।
খানিক যাবার পর আমি কথা পাড়লুম । লোকটি জানালে তিনি তেমন কিছু বোধহয় বলতে পারবেন না । তবে তিনি বুঝতে পারছেন যে বিনোদ ডাকুয়া , যিনি মারা গিয়েছেন তাঁর সম্পর্কে আপনি কিছু জানতে চাইছেন । আমি বললাম ,
-- না , আমি বলছিলাম যে , এই ভদ্রলোক তো কাশ্মীরী নন , তাই না ? আমার মনে হয় বাঙ্গালী , মানে নামে মনে হচ্ছে যে সে একজন বাঙালী আদিবাসী ।
সে মাথা নেড়ে চিন্তিত স্বরে বললেন ,
-- নহী স্যার । আমার মনে হয় বাঙ্গালী নয় , আসামের লোক । কেননা , কখনো কখনো সে অহমিয়া ভাষায় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন শুনেছি । তাঁরা অরুণাচলের কোন জায়গা থেকে এসেছিলেন ।
আমি বললাম ,
-- হ্যাঁ , তা ঠিক বলেছেন । অরুণাচলে অনেক অসমীয়া ও বাঙ্গালীরা থাকেন ।
-- বিনোদ ডাকুয়া , বুঝতেই পারছেন , এখানে এক দু বছর হল রয়েছেন । তিনি ভালই হিন্দী বলতে পারেন । মিসেস ডাকুয়া , একজন খোঁড়া মহিলা --- মানে এখানে ঐ অবস্থাতেই এসেছিলেন । হুইল চেয়ারে চড়ে । অমৃতা ডাকুয়া , বিনোদ ডাকুয়ার একমাত্র মেয়ে । ভীষণ শোচনীয় অবস্থায় রয়েছেন এখন ।
আমি সায় দিয়ে বললাম ,
-- স্বাভাবিক , তিনি তাঁর পিতাকে হারিয়েছেন যখন এরকম এক মারাত্মক ঘটনার মধ্যে দিয়ে ।
-- হ্যাঁ স্যার , উসপর আউর ভী দুখকে বাত উনকে লিয়ে হ্যায় যহাঁ । এই যে সুদেশ বর্মন , যাকে পুলিশে গ্রেপ্তার করেছে , উনি কিছু দিন হল অমৃতা মেমসাহেবের কাছে আসছিলেন , তাঁর প্রেমে মজে ছিলেন জনাব । আর তাইতে মেমসাহেবের আরো কষ্ট হবে হয়তো ।
-- জরুর । আমায় বলতে পারেন , এমন কী ঘটলো যে পুলিশ সুদেশ বর্মনকে গ্রেপ্তার করল ?
লোকটি একটু গুছিয়ে বসে বললে ,
-- জরুর স্যার । যদিও আমি সরাসরি দেখিনি তবে শুনেছি যে গত পরশু বিকেলে বিনোদ ডাকুয়া ও সুদেশ বর্মনের মধ্যে হঠাৎ ঝগড়া বেঁধে যায় । বিকেল নাগাদ বিনোদ ডাকুয়া বেড়াতে বেরিয়ে ছিলেন । পিছন পিছন তাঁকে অনুসরণ করছিলেন সুদেশ বর্মন। দুজনেরই গতি ছিল সেই আউট হাউসের দিকে । মাঠে ভেড়া চরাতে যাওয়া আব্দুল তাদের পাশের চিনার গাছের একটা ছোট্ট জঙ্গল থেকে দেখছিল । সে চিনারের ছায়ায় বসে ওদের দেখছিল । সেই সময় তাদের ঝগড়া বেঁধে যায় । আব্দুল এত দূর থেকে তাদের কথা স্পষ্ট শুনতে পায়নি , কেবল শুনতে পেয়েছিল বিনোদ ডাকুয়া সুদেশকে বলেছেন সেখান থেকে চলে যেতে । তিনি একা থাকতে চান । এবং তা বেশ জোর দিয়ে পায়ে তাল ঠুকে নাকি বলেছিল । এরপর সুদেশ বর্মন সেখান থেকে চলে যায় । আমি মাঝ পথেই বলে উঠলাম ,
-- অরে রুকিয়ে , রুকিয়ে ভাই ; আপনি আমাদের বলেছেন যে , আব্দুল এইসব দেখেছিল ও শুনেছিল । আপনি তা কেমন করে জানতে পারলেন ?
গ্রামীণ জোর দিয়ে বললেন ,
-- আব্দুল আমায় বলেছিল জনাব । প্রতিটি শব্দ সে কাল আমায় বলেছিল । গাঁয়ের সবাই জানে যে ফরিদ মানে আমি আর আব্দুল ছোটবেলা থেকেই বন্ধু ছিলাম সাহাব ।
আমি মাথা নাড়লুম । এতক্ষণে গ্রামীণ ব্যক্তির নাম জানা হয়ে গেল । আমি অতঃপর তাকে কথা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিলাম । সে জানালে আসলে আব্দুল দু'বার এসব কথা বলেছে । একবার সকালে যখন লাশ পাওয়া গেল তখন ফরিদকে । আর তারপর শোপিয়াতে পুলিশের কাছে । তার কাছে পুলিশ জানতে পারে যে সে বিনোদ ডাকুয়ার কাছে কাজ করত না । সে কাজ করত আউট হাউসের মালিক কর্নেল রফিক ডার - এর কাছে । কর্নেলের কাছ থেকেই বিনোদ ডাকুয়া কিঞ্চিত জমি ও বাগান নিয়েছিলেন লীজে । আমি ফরিদকে প্রশ্ন করলাম ,
-- তুমি বললে যে , বিনোদ ডাকুয়া তাকে চলে যেতে বললে সুদেশ বর্মন চলে যায় । তারপর কী হল ?
সে বললে ,
-- সুদেশ বর্মন চলে তো গেলেন সেখান থেকে , কিন্তু একেবারে নয় । কেবল মাত্র বিনোদ ডাকুয়াকে এড়াতে অন্যদিকে সরে এলেন মাত্র । যে চিনার গাছ গুলো মাঠের ঠিক মধ্যিখানে এক মুঠি হয়ে অল্প জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে , তার আড়ালে । একেবারে আব্দুলের পাশে । তারপর গাছের আড়ালে আড়ালে তাঁকে লক্ষ্য রাখতে লাগলেন । দুজনে খানিক এগিয়ে গেলে দুজনেই তার চোখের আড়ালে চলে গেলেন । এরপর সে তাঁদের আর দেখতে পায়নি । সে তার ভেড়া সমেত ফিরে এসেছিল । রাত নামলে হঠাৎ সবাই দেখলে আউট হাউস জ্বলছে ! গ্রামবাসীরা তৎক্ষণাৎ জল টল নিয়ে গ্রাম থেকে দৌড়েছিল মাঠের দিকে । আমি শুধালুম ,
-- আউট হাউস পর কোই রহতা থা ?
ফরিদ জানালে ,
-- নহী স্যার , ওটা তো ভূত বাংলোর মত খালি পড়ে থাকতো । কিছু কিছু জায়গা ভেঙ্গে পড়েছিল । শোনা যায় , এক ব্যক্তি , কর্ণেলের এক আত্মীয় অনেক বছর আগে ওখানে আত্মহত্যা করেছিল । ভয়ে কেউ ঐ দিকে যেতো না । আমি প্রশ্ন করলাম ,
-- সুদেশ বর্মন কব লৌটে ?
ফরিদ জানালে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে অমৃতাকে জানিয়েছিলেন যে সে বিনোদ ডাকুয়াকে আউট হাউসের বাইরে রেখে ফিরে এসে ছিলেন । কিন্তু ঝগড়ার বিষয়ে কিছু নাকি জানান নি । কেবল বলেছিলেন আউট হাউস জ্বলছে । মনে হয় সে আগেই তা দেখেছিল । আমি বললাম ,
-- হত্যার ব্যাপারে সকালের আগে কিছুই শোনা যায়নি ?
ফরিদ মাথা নেড়ে বললে ,
-- নহী সাহাব । অমৃতা মেমসাব বহুত ডর গয়ী থী । উনকা পাপা নহী লৌটনে সে । পরের দিন যখন লোকে জ্বলে যাওয়া আউট হাউসটা দেখতে যায় , তখন ব্যাপারটা জানাজানি হয় ��াশটা দেখতে পাওয়ায় ।
ফরিদের কাছ থেকে আরো জানা গেল যে , লাশটা ভয়ানক ভাবে জ্বলে গিয়েছিল । পুলিশ সঙ্গে ডাক্তার নিয়ে পৌঁছালে , ডাক্তার আবিষ্কার করে জ্বলা লাশের গলা কাটা হয়েছিল । তখন সবাই বিনোদ ডাকুয়ার নিখোঁজ হবার কথা তোলায় পুলিশ অনুমান করে লাশটা তাঁরই । এবং লাশ মর্গে পাঠানো হয় ।
গাঁয়ে ঢোকার মুখে ফরিদের কথায় আমি বা দিকে দূরে মাঠের উপর পুড়ে যাওয়া আউট হাউসটাকে ভুতুড়ে গপ্পের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম । প্রায় আরো মাইলটাক যাবার পর ফরিদ হাত দিয়ে বিনোদ ডাকুয়ার বাড়িটা আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে মেটে রাস্তা ধরে গ্রামের ভিতরের দিকে চলে গেল ।
* রেসটি
বিনোদ ডাকুয়ার বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটা দেখতে সুন্দর । গাড়ি গ্রামের প্রধান সড়ক থেকে চলে যাওয়া প্রায় আধা কিমি পাথর বিছানো পথ পেরিয়ে আমরা বাড়িটার গেটে পৌঁছালাম । পাকা বাড়ি । গেটের দুপাশে মোটা চৌকা থাম । তাতে গাঁথা শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা ' রেসটি '। বোধহয় রেস্ট হাউস থেকে সংক্ষিপ্ত করা নাম । বেশ আদরের নাম । মূল গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা তফাতে বাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে একাকী । চারিদিকে সবুজ ঢেউ তোলা ফাঁকা জমি মাঝে মাঝে দু - দশটা চিনারের ভীড় একঠায় দাঁড়িয়ে । গেটের ভিতর একটা বাগানও আছে । তাতে ফুল গাছের ভীড় । সব রঙের ফুল জায়গাটাকে রঙ্গীন করে তুলেছে । আচমকা আমার নজর পড়ল সামনের দেয়ালে থাকা কাঁচ বসানো জানালায় একটা ভীত ত্রস্ত বিবর্ণ তরুণীর মুখের উপর । আমরা ড্রইং রুমে পৌঁছানোর আগেই দেখা দিলেন অমৃতা ডাকুয়া ।
ভীষণ ফরসা ও বেশ সুন্দরী তরুণীটি । যদিও এখন চোখে মুখে উদ্বেগ ও কান্নার কারণে চোখ লাল , ছল ছল করছে । যদিও সে চোখ বড় নয় অনেকটা চীনে তরুণীদের মত ক্ষুদে । লম্বা হালকা লালচে চুল । দেখেই চেনা যায় এর মিশ্রিত জাতি প্রভাব । সে প্রায় কেঁদে ফেলে বললে ,
-- ও হো মিস্টার হোসেন , ম্যায় বহুত খুশি হুঁ কী আপ আয়ে হ্যায় ।
তারপর সাথে আমায় দেখে থমকালেন , বোধহয় আমার বাঙ্গালী অবয়ব লক্ষ্য কোরে । গুলফাম স্যার আমার পরিচয় দিলেন । তারপর বললেন অমৃতা ,
-- আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা কোরে রয়েছি । আমার মা , বেচারীও এতক্ষণে সন্দেহ করতে লেগেছেন !
আমি শুধালুম ,
-- আপনি নিশ্চই তাঁকে বলেননি , তবে ?
আমার দিকে তাকিয়ে অমৃতা বললেন ,
-- না , বললে তাকেও হত্যাই করা হবে মিঃ ব্যানার্জি। আমার মনে হয় তক্ষুনি তিনি প্রাণ ত্যাগ করবেন । আমি তাকে কেবল বলেছি বাবা শোপিয়ায় যেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন । এখন যে কী করি ?
আমার মনে হল মেয়েটা ভেঙ্গে পড়েছে । গুলফাম স্যার সরাসরি তাঁকে বললেন ,
-- আপ অভী ব্যানার্জি সাহাব কো সবকুছ খুলকর কহিয়ে , যাই হোক উনি যা জানতে চান ঠিক ঠিক জানান । এই কেসে আমাদের যতদূর করা সম্ভব আমরা করবো । কিন্তু আপনি যদি ঠিক মত তথ্য না দিতে পারেন তো আমাদের পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব হবে না মিস ডাকুয়া ।
-- মিঃ ব্যানার্জি , আপনি যদি ওকে জানতেন তবে নিশ্চই এ ���থা জানতে চাইতেন না । সে আমার বাবাকে আঘাত করতে পারে না , হত্যা তো দূর । সে বাবার পিছু পিছু গিয়েছিল কারণ আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম বলে । তা বলে সে কখনোই বাবাকে আঘাত করতে পারেনা । মিঃ ব্যানার্জি আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি , কক্ষনো না । বেচারী বাবা , এখন তো ...
-- সম্ভালে মিস ডাকুয়া । আউর ডরিয়ে মৎ । যদি মিঃ বর্মন নির্দোষ হন --- যা আপনি বলছেন , তো আমরা নিশ্চই কোন একটা উপায় বার করবো তাঁর নির্দোষ প্রমাণ করবার । ব্যাশ্ আপনি কেবল ব্যানার্জি সাহাব কে সহায়তা করুন । আমার মনে হয় তাঁর বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোন প্রমাণ নেই । এরকম ঘটনায় এইটুকু প্রমাণের জন্য পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে মাত্র ।
গুলফাম স্যারের কথায় অমৃতা কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হলে , আমি ফের শুধালুম ,
-- আপনি বলছিলেন যে আপনার বাবা বিকেলে বেরিয়ে ছিলেন , কেন ?
-- আমি ঠিকমত জানিনে মিঃ ব্যানার্জি । আমার মা তার বেরানোয় উৎকন্ঠিত ছিলেন । আসলে মা আমায় কিছু লুকোচ্ছিলো, তা আমায় বলেনি । আমার বাবা কদিন ধরেই বিকেলে বাইরে যাচ্ছিল বলে যে মায়ের উৎকণ্ঠা তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম ।
-- আপনার মা তো চলাফেরা করতে পারেন না , তাঁর এমনি এমনি উদ্বেগ হওয়ার তো কারণ থাকতে পারে না । যদি তিনি সামলে উঠতে পেরেছেন তো তাঁকে আমি দু একটা প্রশ্ন করতে চাই , আপনি কি বলেন ?
কিন্তু অমৃতা এর বিরোধিতা করে বসলেন । তাঁর মা স্পাইনাল কর্ডের সমস্যাতে ভুগছেন , আমার প্রশ্নের ফলে হয়তো তা বৃদ্ধি পেতে পারে , সেই ভয় কোরছেন । তাছাড়া তিনি বাইরের লোকের সামনে বের হন না । কাজে কাজেই এটা এড়াতে পারলে ভাল হয় বললেন । আমি মাথা নেড়ে বললুম ,
-- ঠিক আছে মিস অমৃতা , আমি প্রথমে যাচ্ছি কিছু তদন্ত করতে । দেখা শোনা হলে আপনার মায়ের সহায়তা ছাড়াই কিছু কোরবার চেষ্টা করবো । তবে আপনি আমার আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলে সুবিধা হয় তদন্তে ।
অমৃতার সঙ্গে কথাবার্তায় জানতে পারলাম , লীজ নেবার পর বানানো এই ঘর যেটায় আমরা বসে আছি , যার নাম রেসটি , মাত্র দু বছর আগে তৈরী হয়েছিল । এর আগে তাঁরা শ্রীনগরে ছিলেন । তবে তারা শ্রীনগর থেকে সরাসরি এসে এখানে বসবাস করতে শুরু করেন নি । তার বাবা বিনোদ ডাকুয়ার ব্যাবসার কারণে তারা গুজরাত , মুম্বাই , কোলকাতা , চেন্নাই ঘুরেছিলেন । সেই সময় কোলকাতা থেকে চেন্নাই যাবার পথে সুদেশ বর্মনের সঙ্গে তাঁদের জানাশোনা হয় । সুদেশ বর্মনের চেন্নাইয়ে এক বন্ধু ছাড়া আর কেউ নেই ।
সুদেশ বর্মন সিএ - রং স্টুডেন্ট । বিনোদ ডাকুয়ার বাল্যকাল অরুণাচলের ইটানগরে কেটেছে । সেখানে তাঁর বাবাও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন । তাঁর মাকে ছোটবেলা থেকে অসহায় ও পঙ্গু অবস্থায় দেখে আসছেন অমৃতা । সুদেশের সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে রয়েছে , এটা তাঁদের উভয় পক্ষের অনুমতিতেই হয়েছে । আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল অমৃতার কাছ থেকে । তাঁর বাবার মধ্যে কয়েক মাস হল একটা পরিবর্তন সে লক্ষ্য করছে । এটা কী কারণে তা অমৃতা জানে না । তবে সে লক্ষ্য করেছে তাঁর বাবা মাঝে মাঝে নার্ভাস হয়ে পড়ছেন এবং খুব মুডি হয়ে আছেন । প্রায়ই তাঁকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে , এমন কি মাঝে মাঝে ক্ষেপেও উঠছেন । এরকম স্বভাব তাঁর বাবার মধ্যে অমৃতা আগে কখনই লক্ষ্য করেননি । এটা বোঝা যাচ্ছে অমৃতার কোন ধারণাই নেই সুদেশ বর্মনের সঙ্গে তাঁর বাবার কেন ঝগড়া হয়েছিল । আমার গভীর জেরায়ও আর বিশেষ কিছুই বেরুল না । তবে বিনোদ ডাকুয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আমি বের করতে সক্ষম হলাম । সেই তথ্য সাজালে দাঁড়ায়ঃ
আজ থেকে দিন দশেক আগে , বিনোদ ডাকুয়া বিকেলের ভ্রমণ থেকে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ফিরে এলেন । এবং সেই দিন থেকে প্রতিদিন বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়তে শুরু করলেন । তিনি প্রতি বিকেলেই হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরিয়ে ঐ আউট হাউসের দিকটাতে চলে যেতেন । গত বুধবার মুম্বাই থেকে তাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন সুদেশ বর্মন । কিন্তু তাতেও কোন বাঁধা পড়েনি বিনোদ ডাকুয়ার বৈকালিক ভ্রমণে । সেই সময় মিসেস ডাকুয়ার উৎকণ্ঠা পুনরায় প্রকাশ পায় । এরকম উৎকণ্ঠা আগেও তাঁর মধ্যে দেখা গিয়েছে তাঁর স্বামীর আউট হাউসের দিকে যাবার সময় । কিন্তু এবার উৎকণ্ঠা এতটাই বেশী দেখা গেল যে অমৃতা সুদেশকে তাঁর বাবার সঙ্গী হতে বলেন । সুদেশ বর্মন অমৃতার কথা শুনেই বিনোদ ডাকুয়ার সঙ্গ নেন । কিছুক্ষণ পরে একা ফিরে এসে জানান যে তিনি বিনোদ ডাকুয়াকে হারিয়ে ফেলেন । তিনি নিশ্চই অন্য পথ দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন । এবং এও সংবাদ দেন যে লোকে পথে আলোচনা করছে যে আউট হাউসে আগুন লেগেছে ! রাত্রি বাড়তে বিনোদ ডাকুয়া না ফিরে এলে সুদেশ বর্মন আবারও বেরিয়ে চারিদিকে খুঁজে আসেন । তবুও বিনোদ ডাকুয়া না ফিরে এলে মিসেস ডাকুয়াকে তাঁর শোবার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । সুদেশ বর্মন সারা রাত এখানে সেখানে খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যান । সকালে ভয়ঙ্কর সংবাদটি আসে যে আউট হাউসের ভিতরে একজন মানুষের জ্বলন্ত লাশ পাওয়া গিয়েছে । দুপুর নাগাদ সুদেশ বর্মন গ্রেপ্তার হন ।
অমৃতা ডাকুয়া কথাবার্তার মাঝে নিজের মানসিক অবস্থা ধরে রাখতেও কথা চালিয়ে যান । কথা শেষ হলে আমি গুলফাম স্যারকে ইশারা করতেই তিনি অমৃতাকে বলেন ,
-- মিস ডাকুয়া আপনি শান্ত হোন। উত্তেজিত হবার কিছু নেই ।
আমি স্বান্ত্বনার সুরে বলি ,
-- আপনি আপনার সাধ্যমত মত তথ্য যুগিয়েছেন মিস ডাকুয়া । এখন আমরা গিয়ে সব কিছু পরীক্ষা করে দেখবো প্রাথমিক ভাবে । হয়ত তারপরেই আমরা আপনাকে কিছু ভাল সংবাদ দিতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি । আপনি গিয়ে আপনার মায়ের পাশে থাকুন । মনে রাখবেন আপনাকে সবসময় সহায়তা করে যাওয়া হবে মিস অমৃতা ।
ফেরার সময় হল ঘরের এক কোণে রাখা জুতার সেলফের দিকে চোখ যাওয়ায় একই রকমের ছ জোড়া জুতা দেখে আমি থমকে দাঁড়ালাম । গুলফাম স্যারের চোখের তারায় দুর্বোধ্যতর দৃষ্টি ঝলক মারল । আমি আপনি মনেই নিম্ন স্বরে বললাম ,
-- মিঃ ডাকুয়া দেখছি একই রকম জুতা পছন্দ করেন ! আমার স্বগোক্তি কানে যাওয়ায় গুলফাম স্যারও সেই দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বললেন ,
-- লিবারটি কা জুতে হ্যায় ব্যানার্জি ।
আমরা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলুম ।
* আউট হাউস
রেসটির বা হাতে থাকা মাঠের উপর দিয়ে একটা মেঠো পথ চলে গিয়েছে উঁচু নীচু সবুজ প্রান্তর ভেদ করে উত্তর দিকে । আমাদের গাড়ি চালক সেই দিকে জীপসি গাড়িটা চালিয়ে দিলে পাথুরে জমির উপর দিয়ে । পথের পাশের ঘাসের উপর অনেক পায়ের চাপ পড়েছে বোঝা যায় তীক্ষ্ণ ভাবে লক্ষ্য করলে । আমি গুলফাম স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম সেই দিকে । খানিকটা এগোতেই দু - একটা চিনার বৃক্ষ দেখা দিল । ক্রমশ চিনারের ভিড় বেড়ে দাঁড়াল একটুকরো পাতলা ব - এর আকারের গাছের ভীড়ে । এখানেই যে আব্দুল চিনারের ছায়ায় বসে বিনোদ ডাকুয়া ও সুদেশ বর্মনকে লক্ষ্য করেছিল তা আর বলতে হয়না । গাছের ভীড়টা আউট হাউসের দিকে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে । আরো খানিকটা এগোলে চারিদিকে কেবলই খোলা মাঠের মধ্যে আমরা এসে পড়লাম । চারিদিকে উঁচু নীচু সবুজ মাঠের বিস্তার । চিনার বনের কোন থেকে দেখা গেল দুটো মেঠো পথ এগিয়ে গিয়েছে আউট হাউসের দিকে । ধীরে ধীরে পথ উপরের দিকে চড়তে চড়তে গিয়ে পৌঁছেছে আউট হাউসের গেটে ।
গেট বলতে কেবল দুটো ইটের থাম । চারিদিক খোলা । দুই থামের মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে ঘাসে ভরা জমির উপর দিয়ে একটা সরু পথ আউট হাউসের সামনের বারান্দায় সিঁড়িতে গিয়ে ঠেকেছে । এখন আউট হাউসে��� কড়ি বর্গা ও দেয়ালের কিছু অংশ কালো পুড়ে যাবার চিহ্ন মেখে সত্যি সত্যি এক ভুতুড়ে বাংলো হয়ে দাঁড়িয়েছে । যদিও বাড়িটার মূল কাঠামোটা টিকে রয়েছে । ছাতেরও তেমন ক্ষতি হয়নি । কালে দেখতে বাড়িটা সুন্দরী ছিল বোঝা যাচ্ছে । বাড়িটার ডান হাত দিয়ে আসা রাস্তাটার ধারে কিছু গ্রামীণ ঘর দুয়ারের চালা গুলো উঁকি দিচ্ছে । এই রাস্তাই শোপিয়ার দিকে গিয়েছে । আর আমরা এসেছি বা হাতের গ্রামীণ মেঠো পথে । আউট হাউসের ডান দিকে থাকা আর একটা ছোট গেটে একটা লোকের মূর্তি দেখা যাচ্ছে । সে মনে হয় একজন পুলিশ গার্ড ।
আমাদের জিপসীটা দেখে সে তড়বড়িয়ে এগিয়ে এল আমাদের সামনে । গুলফাম স্যারের উর্দি দেখে বুঝে গিয়েছে যে সে বড় পুলিশ অফিসার । তাই আমরা গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে সেলাম করল । আমি গুলফাম স্যারের কানে নিম্ন স্বরে বললাম ,
-- ইসে কাটাইয়ে গুলফাম স্যার ।
আমার কথায় মৃদু হেসে তিনি হাঁক পাড়লেন ,
-- তুমহারা অফসর কাহা ম্যান ?
সেপাই উত্তর দিলে ,
-- গাঁও কী আউট পোস্ট মে স্যার ।
গুলফাম স্যার ভারিক্কী স্বরে বললেন ,
-- যাও জাকে বুলাকে লাও । আমরা শ্রীনগর থেকে এসেছি। আমরা পাহারা দিচ্ছি , তুমি যাও ।
মানুষটির ইতস্ততা দেখে গুলফাম স্যার জুড়ে দিলেন বাকী কথাটুকু । তাতে কাজ হল বলে মনে হল । সে একটা দ্বিধা ভরা সেলাম ঠুকে গাঁয়ের দিকে শোপিয়া থেকে আসা পীচ পথ ধরে উধাও হল ।
আমরা আউট হাউসে উঠে এলাম । আউট হাউসের বারান্দার উপরে থাকা দুটি দরজার একটিও নেই । আধ জ্বলা চৌকাঠ রয়েছে । জানালার পাল্লা ও চৌকাঠ সম্পূর্ণ জ্বলেছে । সম্পূর্ণ বাড়িটা পোড়া বাড়ির আকার ধারণ করেছে তাতে । আউট হাউসের ডান হাতের দরজার সামনে ছাইয়ের একটা আস্তরণ দেখা গেল । সেই ছাইয়ের বেশির ভাগটা কাঠের ও কাগজের । পোড়া ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ছাইয়ের কিছুটা কালো যা অদ্ভুত আকারে মেঝেতে পড়ে রয়েছে , যেন একটা মানুষ হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে ! গুলফাম স্যার মন্তব্য করলেন ,
-- এহী পর লাশ গিরা হুয়া থা ব্যানার্জি। আপনি আগে দেখেননি বোধহয় ব্যানার্জি সাহাব?
আমি মাথা নাড়লাম , কেননা পুড়িয়ে ফেলা লাশ এর আগে দেখা হয়নি । আমি কাজে নেমে পড়লুম । ভাল করে পোড়া মানুষের দাগটা দেখতে দেখতে একটা জিনিস আমি কুড়িয়ে নিলাম পোড়া ছাইয়ের মানুষটার দাগটার পায়ের শেষ অংশ থেকে । আমি দাগটার চারপাশ ঘুরে ঘুরে সাবধানে দেখতে লাগলাম । হঠাৎ গুলফাম স্যারের চোখে চোখ পড়তে দেখলুম তাঁর চোখ দুর্বোধ্য থেকে দুর্বোধ্যতর হয়ে উঠেছে । ঘরটা টুকরো তার , পোড়া কাঠ আর ছাইয়ে ভরা । তারই মাঝে হঠাৎ ছাইয়ের ভিতর দেখলাম আধ পোড়া কাগজ আর কার্ডের অংশ । আর তার চারধারে বোতল , কাঠের হ্যান্ডেল , প্লাস্টিক , আধ পোড়া রঙের বাক্স ! আমি আধপোড়া কাঠের সঙ্গে লোহার ছড় পেয়ে সেটা দিয়ে ছাই হটিয়ে হটিয়ে দেখতে লাগলাম । হয়ত মিলিলেও মিলিতে পারে অমূল্য রতন !
একটা ছোট্ট শঙ্কর ধাতুর তৈরী বাক্স , তাতে আধপোড়া ব্রাস ও রঙের প্লাস্টিক বক্স ! গুলফাম স্যার বললেন ,
-- কালার বক্স , তাজ্জুব বাত !
আমি নীরস স্বরে বললাম ,
-- ঐ আধ জ্বলা কাগজ ও কার্ড টা দেখুন , হতে পারে স্কেচ বুক হবে ওটা ।
আর বিশেষ কিছু না পাওয়ায় আমরা বেরিয়ে এলাম । দ্বিতীয় ঘরটিতে পুরানো খাটটাট ছিল । আধজ্বলা অবস্থায় । ভিতরের বারান্দা , কীচেন ভষ্মীভূত । আমি ছাইয়ের ভিতর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া মেটাল রিং ও বোতামটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলাম । হতে পারে পায়ের জুতাটাও আধা পুড়লে তা থেকে এগুলো আলগা হয়ে পড়ে গিয়েছে । আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সদ্য দেখে আসা রেসটির হলঘরে থাকা জুতোর রেকটা । বিনোদ ডাকুয়ার আধা ডজন জুতোর কোনটাতে এ ধরনের কোন মেটাল রিং বা বোতাম লক্ষ্য করিনি ।
আমার স্বগোক্তি বোধহয় গুলফাম স্যারের কানে গিয়েছিল । ঘরটার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন । তাঁর গোঁফের তল দিয়ে গম্ভীর চিন্তিত স্বর মেলে দিয়ে বললেন ,
-- ক্যা বোলে ব্যানার্জি সাহাব ?
-- মুঝে নহী লগতা হ্যায় কী , বিনোদ ডাকুয়ার হত্যা হয়েছে । আই মীন, সে মৃত নয় ।
আমার কথায় স্পষ্টতই চমকে উঠে উনি শুধালেন ,
-- ক্যা বোলতে হ্যায় আপ !
আমি বূঝতে পারছিলাম এটা মেনে নেওয়া গুলফাম স্যারের পক্ষে খুবই কষ্টকর । লাশ যেখানে আধজ্বলা অবস্থায় মজুদ সেখানে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না । আমি বললুম ,
-- আমার এটা মনে হচ্ছে গুলফাম স্যার । দেখুন আমরা জানি যে লাশটি এতটাই জ্বলেছে , বিশেষ করে আপার পোরশন , যে লোকটির মুখ চেনা দুষ্কর । বিনোদ কুমার নিখোঁজ হওয়ায় গ্রামের লোকেদের মনে চেপে বসেছে যে এটা তাঁরই লাশ । তাছাড়া আমরা আরো জানি যে বিনোদ কুমারের পরিবারের কেউ গিয়েই সে লাশ এখনো সনাক্ত করেনি । তাই বলা যায় না এটা তাঁরই লাশ ।
গুলফাম স্যার তাঁর গোঁফের তল দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত করে আওয়াজ করলেন প্রতিবাদের ভাষায় । বললেন ,
-- লেকিন উনকা এ বডি নহী হ্যায় তো ঔর কিসকা হ্যায় ব্যানার্জি ?
-- আপনে ঠিক কহা, এ কিসকা হ্যায় ?
তারপর আমি তাঁকে বোঝালাম যে গুলফাম স্যার এখানে যা দেখতে পেয়েছেন তাকে কাজে লাগিয়ে ভেবে দেখুন । এখনো পোড়া ছাইভস্মের মধ্যে পড়ে আছে একটা রঙ বাক্স , আঁকার আধ পোড়া তুলি আর পোড়া স্কেচ বুকের পাতা । কে এই রঙের বাক্স ও স্কেচ বুক নিয়ে এসেছিল এখানে ? বিনোদ কুমার যখন বেরান তখন হাত খালি ছিল । তাছাড়া তাঁর স্কেচ করার অভ্যাস সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি অমৃতা ডাকুয়ার কাছে থেকে । এমনকি আবদল্লার বর্ণনায়ও কালার বাক্স বা স্কেচ বুকের উল্লেখ নেই । তারপর এই আকা বাঁকা তার গুলো । এগুলো জুতার বোতামে জড়িয়ে থাকে । আমার মতে লাশের পায়ের জুতা পুড়ে যাবার ফলে তার জুতার বোতাম থেকে খসে পড়েছে । তাছাড়া বোতামের ধাতুর অংশ গুলো যা ওখানে পড়ে রয়েছে তার সংখ্যা এখান থেকে স্পষ্ট গোনা যায় । সে গুলোর মোট সংখ্যা ছয় আর ছয়ে বারোটি । অথচ বিনোদ কুমার লেস বাঁধা জুতা পড়তেন তার উদাহরণ আমরা তাঁর রেকে দেখে এসেছি । নয় কি ? গুলফাম স্যার স্পষ্টতই চমকে উঠলেন আমার বিশ্লেষণ শুনে । তিনি অবাক স্বরে শুধালেন ,
-- যদি বিনোদ কুমার কা মৌত নহী হুয়া হ্যায় তো ওহ কাহাঁ গয়ে ব্যানার্জি সাহাব ?
-- লাখ টাকার প্রশ্ন করেছেন স্যার আপনি । সে গেল কোথায় ? এর আগে আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে ওটা তবে কার লাশ ছিল ? খুন হওয়া ব্যক্তিটি তবে কে ? এখন বোধহয় আপনি বুঝে গিয়েছেন যে এ কেসের সম্ভাবনা গুলি কী কী স্যার ।
গুলফাম স্যার দু চোখ বুজে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন । তারপর হঠাৎ তাঁর চোখ খুলে গেল । গোঁফের তল দিয়ে দেখা দিল এক টুকরো হাসি । আমি বুঝতে পারলাম উনি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন যে এটাই হল একমাত্র সঠিক ব্যাখ্যা এই গোটা ঘটনাটার । এটাও বুঝতে পারছেন যে কেন হঠাৎ করে বিনোদ কুমারের সাম্প্রতিক কালে আব ভাব বদলে গিয়েছিল । কেন তিনি প্রতিদিন বৈকালিক ভ্রমণে বেরুচ্ছিলেন আর কেনই বা সুদেশ বর্মন তাঁর পিছু নিলে বিরক্ত হয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । আর শেষ মেষ তাঁর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা --- সব কিছু যেন যুক্তি যুক্ত হয়ে আসছিল ।
এই অদ্ভুত কেসটা আরো অদ্ভুতের দিকে মোড় নিয়েছিল আমাদের দুজনেরই মনে । রহস্যের কুয়াশা হটাতে যেয়ে আমরা জড়িয়ে পড়লাম আরো কুয়াশার গহীন আঁধারে ! তারপর আউট হাউসের সামনের আধা জঙ্গলা বাগানে দুজনে দুজনের দিকে অর্থবহ দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
* রহস্যের কুয়াশা
আমরা রেসিপি ছাড়বার আগে অমৃতা ডাকুয়াকে আশ্বস্ত করে এসেছিলাম তাঁর হবু বরকে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়িয়ে আনবার ব্যবস্থা করব । কিন্তু পরিস্থিতি আশঙ্কার হয়ে উঠেছে বিনোদ ডাকুয়ার কোথাও নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কারণে । আমাদের পরস্পরের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকার নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে গুলফাম স্যার স্বগোক্তি করে উঠলেন ,
-- বেচারী লড়কী ! আমার মনে হয় ব্যানার্জি তাঁর জন্যে এই কথা জানাই ভাল হবে যে তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছে ।
-- হ্যাঁ গুলফাম স্যার । এই মেয়ের জন্য এটাই বোধহয় ঠিক । তবে অনেক ভাল মানুষ বলবেন যে মেয়েটির জন্য এবং তাঁর মায়ের জন্যও কিছু করা উচিত । তাছাড়া সুদেশ বর্মনের জন্যেও কিছু করা দরকার গুলফাম স্যার । যাই নেমে আসুক বিচার অবশ্যই করা হবে , যেমন টা সাধারণতঃ হয়ে থাকে । নির্দোষ এবং দোষী উভয়ের জন্যই । আপনি বুঝতেই পারছেন যে আমার মাথায় একটা অন্য ধারণাও রয়েছে । কাজেই এখানে দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিন , আর আমি চেষ্টায় নামি ।
বলেই আমি আউট হাউস ঘিরে যে খোলা জায়গা আছে তা পরীক্ষা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । আমার মাথায় তখন হাজারো প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি দিতে শুরু করেছে । চারধার ভাল করে লক্ষ্য করতে করতে সেই সব প্রশ্নের সম্ভাব্য সমাধানের চিন্তায় বিভোর হয়ে গেলাম আমি । প্রায় ঘন্টাটাক পরে গুলফাম স্যারের ডাকে আমি চমকে উঠে বর্তমানে এলাম ।
-- ব্যানার্জি সাহাব , আ জাইয়ে । এ পুলিশ কা আদমী গিয়া কাঁহা ? শোপিয়া নহী গিয়া তো ?
-- হমে ক্যা উসকে লিয়ে ওয়েট করনা পড়েগা স্যার ?
-- হাঁ ব্যানার্জি সাহাব । যো ভী প্রমাণ ওহ তো ইস ঘরকে ফর্শ পর বিছা হুয়া হ্যায় । ছেড়ে যাই কী করে ? ঐ তো সে আসছে ।
স্থানীয় পুলিশের মোটা শরীর উদয় হল নীচের রাস্তায় । আমরা চিৎকার করে তাঁকে ডাকলাম জলদি আসবার জন্য । হেলতে দুলতে অবশেষে এই টিলার উপর উঠে এল সে । যখন তাঁর মূর্তি দেখা দিয়েছে এমন সময় একটা আওয়াজ শোনা গেল । কিছুক্ষণ পরে একটা অটো রিক্সার আওয়াজ পাকা রাস্তার দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল । আমরা দেখলাম একটা অটো রিক্সা শোপিয়ার দিক থেকে গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে । আমরা এসে দাঁড়ালাম রাস্তার কাছে ।
দূর থেকেই অটোচালক প্রায় চিৎকার করে কিছু বললে । দূরে থাকায় আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না । ক্রমে অটো রিক্সা এসে পড়ল আমাদের কাছাকাছি । অটো থামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে নামলেন লাল টকটকে রঙের স্লিম চেহারার একজন বয়স্ক মানুষ । আস পাশ দেখে নিয়ে তিনি আমাদের দিকেই উঠে আসতে লাগলেন । তাঁকে দেখে পুলিশটি প্রচন্ড চমকে উঠে পাশের একটা ডোবায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল । গুলফাম স্যার খপ করে ধরে ফেললেন । পুলিশটির বিস্ফারিত চোখে অন্তহীন বিস্ময় দেখা গেল ।
-- এ ... ই ... তো তি - নি !
গ্রামের অটোচালকটি বললেন ।
-- একদম ঠিকঠাক রয়েছেন ।
-- তোমার মুখ বন্ধ করে তো , বুদ্ধু কাঁহিকা। তুম তো মুঝে মজাক শোচা হ্যায় য়ার।
ড্রাইভার ততোধিক উত্তেজিত, উত্তেজিত স্বরে বললে ,
-- আপকো ? কভী নহী ! মুঝে পয়সা কা জরুরত নহী হ্যায় জনাব , ম্যায় আপকো বাস্ ঘর পৌঁছানে আয়া হুঁ গর্ব সে ঔর সম্মান কে সাথ । এহী ও হ্যায় সাহাব !
শেষ কটি শব্দ বোধহয় আমাদের জন্যে বললে ড্রাইভার ।
আমার মাথা তখন ঝিলিক দিয়ে উঠেছে । উত্তেজিত অটোচালক , বিস্মিত পুলিশটিও রাগান্বিত মানুষটি আমায় একযোগে বলে দিয়েছে আমিই একশো শতাংশ ঠিক । রাস্তার পাশের অনতিউচ্চ মাঠ থেকে লাফিয়ে নেমে আমি উঁচু গলায় বললুম ,
-- মিঃ বিনোদ ডাকুয়া , আমার যতদূর অনুমান ?
উনি ম্লান হেসে বললেন ,
-- হ্যাঁ স্যার , কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না !
গুলফাম স্যার নেমে এসে দাঁড়ালেন পথের উপর । গোঁফের ফাঁক দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন ,
-- য়হা বহুত কুছ হো গয়া হ্যায় মিঃ ডাকুয়া । আপনি নিখোঁজ হওয়ায় আপনার মেয়ে অমৃতা আমায় মেল করে ছিলেন । আমি শ্রীনগর থেকে এসেছি । আমি জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মুখ্য আধিকারিক । আর ইনি হলেন মিঃ ব্যানার্জি , আমাদের পুলিশের একজন শুভচিন্তক সাথী , ক্রাইম রাইটার ও ক্রাইম ডিটেক্টর । আমায় সহায়তা করার জন্য আমার সঙ্গে এসেছেন । আপনার সঙ্গে আমার একান্তে কিছু আলাপ করার আছে জনাব ।
গুলফাম স্যার উনাকে নিয়ে খানিক তফাতে চলে গেলেন ।
অবশেষে আমরা এসে বসেছি বিনোদ ডাকুয়ার স্টাডিরুমে । মিসেস ডাকুয়াকে দেখে গিয়েছেন ডঃ আহমেদ শোপিয়া থেকে এসে । নার্সকে রেখে গিয়েছেন তাঁর পরিচর্যার জন্য । অমৃতা ডাকুয়া আমাদের কফি সার্ভ করে আর ফিরে যাননি বিনোদ ডাকুয়া তাঁকে বসতে বলায় । তবে ছাড়া পেয়ে সুদেশ বর্মন এখন আরো প্রাণবন্ত দেখাচ্ছেন । তিনি তাঁর অবস্থা তাঁর মা বাবাকে জানাতে রওণা হবেন কোলকাতার দিকে । বাইরে মনোরম সন্ধ্যা নেমে আসছে ।
বিনোদ ডাকুয়া আমার দিকে চেয়ে ঝরঝরে বাংলায় বললেন ,
-- জানিনা মিঃ ব্যানার্জি স্যার আমি কোথা থেকে শুরু করবো । আউট হাউসের খুনের ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা । আশা করি পুলিশ তা তদন্ত করে জানতে পারবে । কারণ আউট হাউসে ঢুকে খুনের লাশ দেখার চাইতেও আততায়ীর পলায়নপর মূর্তি আমায় বেশী আকর্ষণ করেছিল । আর আগুন তখনও ঠিকঠাক জ্বলে উঠতে পারেনি বলে আমার বিশ্বাস । কাল সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি , তাই এখন ফিট লাগছে না । তবুও আপনাদের কাছে সবটা বলতে পারলে কিছুটা হালকা বোধ করব ।
গুলফাম স্যার বললেন যা আমরা অমৃতা ডাকুয়ার কাছ থেকে জানতে পেরেছি । শুনে বিনোদ ডাকুয়া বললেন ,
-- ওহো ! তাহলে অমু মনে করেছিলি যে আমি ভীষণ মেজাজী হয়ে উঠেছি মাস খানেক ধরে ! সত্যি তাই । অমৃতা মৃদু মাথা হেলাল বাবার প্রতি । উনি হেসে বললেন ,
-- আপনারা আশিকুর রহমানের কেস তদন্ত করেছেন আমি তা যদ্দুর সম্ভব নিউজ পেপার থেকে জানতে পারি ।
গুলফাম স্যার মাথা নেড়ে সমর্থন জানালেন । উনি বললেন ,
-- এ ছাড়াও মুম্বাইতেও একটা কেসে ঠিক অমনই ঘটেছিল । সব শেষে ডঃ নাজির আহমেদ চৌধুরী । আপনারা কি জানতে পেরেছিলেন সেই আততায়ীর নাম ?
গুলফাম স্যার বিস্তারিত নেত্রে বিনোদ ডাকুয়ার দিকে চেয়ে রইলেন । আমি গলা ঝেড়ে বললাম ,
-- এ পর্যন্ত তার দুটি নাম আমরা জানতে পেরেছি । জাহিদ গনাই ও জুনেইদ মাট্টু !
বিনোদ ডাকুয়া গলা ঝেড়ে বলে উঠলেন ,
-- না ও জাহিদ গনাই হ্যায় , ঔর না জুনেইদ মাট্টু । আজ থেকে বিশ সাল আগে আমি ওকে জানতাম আবু বকর জুনেজা নামে । ও বাংলাদেশে থাকা এক পাকিস্তানী লোক ছিল ।
* আবু বকর জুনেজা
এরপর উনি যা বললেন তা এই রকমঃ ব্যানার্জি স্যার আবু বকরের এ অসামাজিক জীবন অসামাজিক কার্যকলাপে ভরা । এবং তার কার্যকলাপে যদি কেউ দুর্ভোগ ভুগে থাকে তা নিঃসন্দেহে আমি । বিনোদ ডাকুয়ার মুখ হিংস্র হয়ে উঠতে শুরু করেছিল । তাঁর বৃদ্ধ সুলভ আচরণ উধাও হয়েছিল , চোখ দুটো ধ্বক্ ধ্বক্ করে জ্বলছিল ও নাক ফুলে উঠেছিল । তিনি এ ভাবে কিছুক্ষণ সোজা হয়ে বসে রইলেন । অমৃতা তাঁর অবাক নেত্র দুটি মেলে দেখছিলেন তাঁর পিতৃদেবকে । তারপর বিনোদ ডাকুয়া ধীরে ধীরে শান্ত ভাবে চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন । তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন , হয়ত যতটা তেজ থাকা দরকার তা নেই , তবুও তিনি পথ ছাড়বার লোক নন ।
আবু বকর একজন পাকিস্তানী । অতীতে সে তালিবানদের সাথে যোগ দিয়েছিল । আমেরিকান এজেন্সী তাকে কুকুরের মত শুঁঘে শুঁঘে তার জীবন অতিষ্ঠ কোরে তোলায় সে পালিয়ে যায় বর্মার এক সীমান্ত প্রদেশে । যেটা সেই সময় ছিল নো ম্যানস ল্যান্ডের মত । না চায়নার না বর্মার আবার না ভিয়েতনামের । এখানের সরকারী লোকজনেরা ছিল অনেকটা স্বাধীন সরকারের মত । এবং তারা নিজেরাই গড়ে তুলেছিল এক অপরাধের কালো জগত । মূল কারবার ছিল এদের পপি চাষ ও আফিম ও তৎজাত নানা ড্রাগস তৈরী করা । এবং এটা জুড়ে ছিল গোল্ডেন ট্রাঙ্গেলের সাথে । আবু বকরের ছিল অপরাধিক মস্তিষ্ক । এবং তার মাথা ছিল ক্ষমতা অর্জনের জন্য ভীষণ সাফ ও তীক্ষ্ণ । যদিও সে রাজনৈতিক শক্তি হস্তগত করবার পক্ষে মোটেও উৎসাহী ছিল না । কেননা ঐ রকম অঞ্চলে তা কেবল মৃত্যুর দিকেই নিয়ে যেত । আবু বকর ছিল শেয়াল স্বভাবী লোক । সে কেবল এই রাজনৈতিক শক্তি বদলের ষড়যন্ত্রের মূল মস্তিষ্ক ও তার দ্বারা আয়ের পথ প্রশস্ত করার কারিগর । কাজে কাজেই সে হয়ে বসেছিল গুপ্ত উপদেষ্টা এই হাত বদলের ইতিহাসের ।
সেই সময় আমি ছিলাম এক জোয়ান ব্যক্তি । আমি আসামের সীমান্তে ব্যবসায় লিপ্ত ছিলাম । আমিও লাভের আশায় সেই সীমান্ত অঞ্চলে ব্যবসা শুরু করি । যদিও ওখানে ব্যবসা করা কিন্তু ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ । কিন্তু লাভ বেশি থাকায় টিকে গিয়েছিলাম । দেখতে দেখতে আমি ধনী হয়ে উঠতে লাগলাম । ঐ সময় যদি সরকারী ক্ষমতার একজন শরিক না হলে তো সেখানে অন্তত একজনের সঙ্গে যুক্ত থাকা একান্ত প্রয়োজন ছিল । কাজেই আমি আবু বকরের মোরগা হিসেবে দেখা দিলাম । কেবল আমি নই , আমার স্ত্রী , যে আজ পঙ্গু হয়ে বিছানায় সেও জড়িয়ে পড়েছিল তার জালে ।
তাঁর গলা ধরে এসেছিল বলতে বলতে । গলা ঝেড়ে একটুক্ষণ দম নিয়ে ফের শুরু করলেন তাঁর অদ্ভুত কাহিনী বৃদ্ধ বিনোদ ডাকুয়া চেয়ারে হেলান দিয়ে । আমরা উৎসুক হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইলাম। তিনি ধীরে পুনরায় শুরু করলেনঃ
এক কথায় আবু বকর তার শয়তানি বুদ্ধি লাগালে আমার পিছনে । কিন্তু যে পুলিশ অফিসারটিকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন , তিনি আমার বহুদিনের পরিচিত হওয়ায় আগাম খবর পেয়ে গেলাম । আমাদের প্রস্তুত হয়ে মাঝ রাতে যুদ্ধে নেমে পড়তে হল । আমি আমার স্ত্রী ও তিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে পালাবার জন্য এক জীপ নিয়ে চললাম পশ্চিম দিকে যেখানে ভারতের বর্ডার রয়েছে । কিন্তু কোন কাজে এল না । কোন রকমে আমি এসে উপস্থিত হলাম সীমান্ত লাগোয়া এক গ্রামে , যেখানে আমার এক বন্ধু থাকতেন । কিন্তু আবু বকর কুকুর নিয়ে আমাদের পিছনে ধাওয়া করেছিল । আবার জঙ্গলে পালাতে হল । বর্মার ঘোর অন্ধকার জঙ্গলে আমরা পথ হারালাম । অমৃতা তখন খুবই ছোট , সে ছিল তার মায়ের কোলে । সে তাকে পিঠে বেঁধে নিয়ে চলেছিল । আমার সঙ্গে ছিল আমার দুই ছেলে । তারা দুজনেই এক কালান্তক জ্বরে এক চোরাবালির জলাশয়ের ধারে আমার এই দুই হাতের মধ্যে মারা গিয়েছিল ব্যানার্জি স্যার ! এমন কি আমার দেহে এতটা শক্তি ছিলনা যে আমি তাদের কাঠ জ্বেলে না পারি , সমাধি দিয়ে আসি । সেই চোরাবালির জলাশয়ে একটু একটু করে আমাদের আদরের সোনাদের আমি তলিয়ে দিয়ে এসেছি ব্যানার্জি স্যার !
আমরা সবাই স্তব্ধ । রুমাল মুখে চাপা দিয়ে ফোঁপাচ্ছিলেন অমৃতা । সবার চোখও বুঝি ভরে উঠেছিল । তিনি এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ,
-- অবশেষে আমরা পেরেছিলাম --- হ্যাঁ আমরা পৌঁছাতে পেরেছিলাম সীমান্তে । সেদিন আমাদের যুদ্ধের পঞ্চম দিন ছিল । দূরে বি এস এফ - দের চৌকির উপর উড়তে থাকা ত্রিরঙা আমাদের দেহে নতুন শক্তি এনে দিয়েছিল ব্যানার্জি স্যার । হোসেন স্যার সে যে কী শান্তি তা বলে বোঝাতে পারবোনা । আমাদের তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোগান্তি হয়েছিল অমু মার । আমার স্ত্রী তাকে বুকে আগলে নিয়ে এসেছিল সারাক্ষণ । সে এত ছোট ছিল যে প্রায় কিছুই তার বোধগম্যের মধ্যে ছিল না । তাঁর মা তাকে রক্ষা করতে পেরেছিল --- কিন্তু আমি আমাদের ছেলে দুটোকে বাঁচাতে পারিনি ব্যানার্জি স্যার ! বাঁচাতে পারিনি !!
বেশ কিছুক্ষণ ভাবাবেগে আপ্লুত বিনোদ ডাকুয়া চুপচাপ বসে রইলেন । তারপর বললেন ,
-- আমায় মাফ করবেন জেন্টেলম্যানেরা, আমি আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলাম । আমরা মাথা নাড়তে তিনি ফের ধরা গলায় বাকিটুকু বলতে শুরু করলেনঃ
-- আর বিশেষ কিছু বলবার নেই । এরপর ভিয়েতনাম ও মায়াম্মার সরকারের প্রচেষ্টায় সেই স্বয়ম্ভু সাম্রাজ্যের অবসান হয়েছিল । আবু বকর সে দেশ ছেড়ে চীনে পালিয়ে গিয়েছিল । যদিও এটা একটা গুজব ছিল যে আবু বকর অনেক দিন চীনে কাটিয়েছিল । যাই হোক , ভারতে আমার পরিবারের অনেক সদস্য ছিল উত্তরবঙ্গে । আমি তাদের সহায়তায় আবার ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু করি । আমার পয়সা কড়ি বাড়তে থাকে ও আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করি ।
* আবু বকরের পুনরাবির্ভাব
বাইরে ��্বর্ণাভ গোধূলির রঙে কালি গুলে চলেছে প্রকৃতি । আমরা কটি প্রাণী রেস্টির ভিতরে বিনোদ ডাকুয়ার মুখে শুনে চলেছি এক অত্যাশ্চর্য আধুনিক রূপকথা । তিনি ফের শুরু করলেন ,
-- গত পরশু যখন আমি আবার আবু বকরকে দেখতে পাই ও তার পিছু নিই ।
গুলফাম স্যার প্রশ্ন করলেন ,
-- ঔর আউট হাউস মে জো আদমী কা খুন হুয়া হ্যায় ওহ কৌন হ্যায় ?
-- এ আবু বকর কা হাতো মে মারা গয়া হাজার হাজার লোগো মে সে কোই একজন হ্যায় হোসেন সাহাব। তবুও এই খুনটা একটু আলাদা বৈকি । আশিকুর ও ডঃ নাজিরের খুন আমাকে ভাবিয়ে ছিল । দুই খুনেই দেখি দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু এবং এর চিকিৎসীয় প্রমাণ বলে এদের টার্নিকোয়েট দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল । দ্বিতীয় হত্যায় তো মৃতের গলাতেই টার্নিকোয়েট ছেড়ে রেখে পালাতে হয়েছিল ।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম ,
-- হ্যাঁ , আমিই তা ঢিলে করে দিয়েছিলাম !
-- তাই নাকি !
বিনোদ ডাকুয়া বললেন ,
-- সেই সয়ম্ভু রাজ্যে আবু বকরের শত্রুরা হঠাৎ হঠাৎই গভীর রাতে মারা যেত দম বন্ধ হয়ে । এবং সব ক্ষেত্রেই অস্ত্র কিন্তু ছিল এক , টার্নিকোয়েট ! আমার মনে হয় এতে খুব দ্রুত , প্রভাবী ও নিঃশব্দে খুন করা যেত বলেই আবু বকর এতে হাত পাকিয়েছিল ।
-- আবু বকর কা শিকার কে মাথে পর ঐসা চিহ্ন ক্যা পহলে ভী দিখাই দেতা থা ?
গুলফাম স্যারের প্রশ্নে বিনোদ ডাকুয়া বললেন ,
-- হাঁ হোসেন সাহাব । ওখানে এরকম ডাইনি বিদ্যার খুব প্রচলন ছিল । এ ডাইনি বিদ্যা হয়ত এসেছিল বিদেশ থেকে । ওয়েস্ট ইন্ডিজে এ ধরনের বিদ্যাকে ভুডু বলা হয় ।
আমার মনে পড়ল পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের কথা । সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে এক মারণবিদ্যা প্রচলিত ছিল । যাকে তাদের ভাষায় বলা হত ভুডু । তারা যাকে মারতে হবে তার অজান্তে বা জ্ঞানতই একটি চিহ্ন দিয়ে দিত কপালে --- একটা লাল ত্রিকোণ ! এর সাথে নাকি , যাকে চিহ্নিত করা হত সে এসে যেত ভুডু চালানো ব্যক্তির বশে । সে যা চাইতো , তাই তাকে দিয়ে করাতে পারতো । মনে হয় আবু বকর তার শিকার কে এই মারণ বিদ্যার সাহায্যে বোবা করে নিতো মারবার আগে ! আমার আরো অনুমান , আবু বকর চীনে থাকা কালীন ঐ সীলের রঙটির ব্যবহার পদ্ধতি শেখে । এতে তার মারণ বিদ্যার হয়তো শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে ।
বিনোদ ডাকুয়া ফির শুরু করলেন বলতে ,
-- আমার মেয়ে অমৃতা আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য কোরেছিল , এমন কি আমার স্ত্রীও । তার মধ্যে প্রতিক্রিয়াটা বেশি হয়েছিল , কেননা এর কারণটা তার জানা ছিল । ব্যানার্জি স্যার আমি একজন বয়স্ক ব্যক্তি , কিন্তু আমার রক্ত আপনাদের চেয়ে ব���শি গরম জানবেন । আমার শারীরিক ক্ষমতা হয়ত কিছুটা হ্রাস হয়ে থাকবে । আমার মা ছিল একজন চৈনিক লড়াকু ট্রাইবাল জাতির । যারা যুদ্ধবাজ শ্রেণীর ছিল । চীন ও সংলগ্ন এলাকায় তাদের বীরত্বের গাঁথা আজও শোনা যায় । তাই আমার সহজাত প্রবৃত্তি আমার বর্বর পূর্বপুরুষদের মতই ভয়ঙ্কর আজও ! আপনারা আমায় কী ভাবছেন আমি তা জানিনা , তবে বলতে পারি এখনও ঠান্ডা মস্তিষ্কে যে , যে মানুষটি আমার সর্বনাশ করেছে , তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা আমার পবিত্র কর্তব্য । আর তার জন্য আমায় যে মূল্য দিতে হয় তা আমি অবশ্যই দিব ব্যানার্জি স্যার । মিঃ হোসেন সরকারী মানুষ , হয়ত তাঁর একথা অনৈতিক ও আইন বিরুদ্ধ মনে হতে পারে , তবে তাতে আমার ভিতরের সুপ্ত প্রবৃত্তিকে বাগ মানাতে পারবে না । গত সপ্তাহে আমি হঠাৎই দেখা পেলাম আমার সেই চির আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির । আগপাশতলা বদলে ফেলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে । কিন্তু আমার চোখকে সে ফাঁকি দিতে পারেনি পুরোপুরি । তবে মাঠের মধ্যে ঐ পোড়া আউট হাউসে তাকে দেখে আমি প্রথমটায় ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলাম ।
সন্ধ্যার আলোয় তাকে দেখলাম এক যুবকের সঙ্গে কথা বলতে । তারপর আমি সম্বিত ফিরবার আগেই তারা চিনারের বনে হারিয়ে গেল । কিছু পরে যুবকটিকে আমি দেখলাম একলা দাঁড়িয়ে আছে বনের বাইরের মাঠে । একদম যৌবনের দ্বারে তাঁর বয়স । হাতে স্কেচ বুক তাঁর রঙতুলি --- একজন আর্টিস্ট ! তারপর থেকে প্রতিদিন আমি বৈকালীন ভ্রমণ আউট হাউসের দিকেই সারতে শুরু করলাম । প্রায়ই দেখি আর্টিস্ট যুবকটিকে আউট হাউসে অপেক্ষা করতে । কিন্তু কেউই তাঁর সাথে দেখা করতে আসছিল না । সে বোধকরি পিছনের যে বস্তিটা আছে , তাতে থাকে । তাঁকে আমি সেই দিকে চলে যেতে দেখেছি ।
অবশেষে এলো সোমবারের গোধূলি বেলা । আবার আমার চোখে পড়ল আবু বকর । সুদেশ এখানে এসেছিল । যখন আমি বিকেলে বেরুলাম সে আমার পিছু নিয়েছিল । অনেক কষ্টে তাকে পিছু নেওয়া ছাড়ালাম । আউট হাউসের মাঠে আমি তার দৃষ্টি এড়াতে সক্ষম হলাম । দেখলাম আবু বকর আর সেই যুবককে আবার একসাথে । আমি তাদের চোখে চোখে রাখতে লাগলাম । কিন্তু সন্ধ্যে নেমে আসছিল । কাজেই সর্বক্ষণ তাদের নজর রাখা সম্ভব হচ্ছিল না । একসময় হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আবু বকর দ্রুত আউট হাউস ছেড়ে শোপিয়া যাওয়ার রাস্তার দিকে চলেছে । আমি সঙ্গে সঙ্গে তার পিছু নিলাম । সেই সময় ক্রোধে নিজেকে বাস্তবিক উন্মত্ত মনে হচ্ছিল । মনে হচ্ছিল তাকে সেই মুহূর্তে সাবড়ে দিই । কিন্তু কৌতুহল হল , সে যাচ্ছে কোথায় ? বিড়ালের মত আমারও ইচ্ছে হল শিকার কে একটু দৌড় করানোর । গতকাল রাত্রে আমি ঘরে খবর দিতে পারিনি । আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করি না । এদিকে আবু বকর দেখলাম চলেছে শ্রীনগর । আমি কোন কিছু না ভেবে তার পিছু নিলাম । কিন্তু তবুও তাকে আমি হারিয়ে ফেললাম শ্রীনগরে লোকজনের ভীড়ে !
গুলফাম স্যার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন ,
-- কেমন করে ?
বিনোদ ডাকুয়া অদ্ভুত চোখে তাঁর দিকে চেয়ে বললেন ,
-- বোকার মত ! আমি তাকে একটা বাড়িতে ঢুকতে দেখলাম । অপেক্ষা করতে লাগলাম বাইরে । সে বেরুলে আমি আবার তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলাম । ভাল লেকের কর্নারে কিছু লোকজন ভীড় করেছিল । তাদের কাটিয়ে চলবার সময় মাঝপথে হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম , আমি যাকে অনুসরণ করে চলেছি সে আবু বকর নয় ! আমি শুধু শুধু গভীর রাত পর্যন্ত বুলেভার্ড ও শ্রীনগরের পথে পথে তাকে বৃথাই খুঁজে ফিরলাম । নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছিল তখন । বাড়ি ফিরবার বাসও নেই তখন । তারপর ফিরে এলাম সেই বাড়িটির সামনে । কিন্তু কোথায় কী ! তারপর হোটেলে গিয়ে বাকী রাত কাটিয়ে ফিরে এলাম ।
আমি বিনোদ ডাকুয়ার জ্বলে ওঠা মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলাম ,
-- যে বাড়িটাতে আবু বকর ঢুকেছিল আমায় তার ঠিকানাটা বলতে পারেন মিঃ ডাকুয়া ? আর যে জায়গাটিতে আপনি তাঁকে হারিয়ে ফেলেন , সেই রাস্তাটার নাম ? প্লীজ ।
বিনোদ ডাকুয়ার চোখে বন্য আলো ঝলসে উঠতে দেখলাম । তিনি চোখ বুজে বললেন ,
-- আমার মনে হয় আমি এখন তা বলতে অক্ষম । আমি আরো দুদিন দেখতে চাই । কারণ আবু বকর প্রথমে আমার আসামী , তারপর আপনাদের শিকার । আমি তার ঠিকানা আপনাদের অবশ্যই বলবো ব্যানার্জি স্যার ।
* হাতে রইল শূন্য
অবশেষে আমাদের মোহ ভঙ্গ হল । অনেক অনুরোধেও বিনোদ ডাকুয়া আমাদের শ্রীনগরের সেই ঠিকানা দুটি বললেন না । অতএব আমি আর গুলফাম স্যার উঠে পড়লাম । রেসটি থেকে বেরিয়ে আমরা চললাম শ্রীনগরের পানে । রাতে আমায় হোটেল আদুসে নামিয়ে দিয়ে গুলফাম স্যার চলে গেলেন ।
পরের দিন ডাল লেকের কিনারে কফি হাউসে বসতেই শুনলাম পেপার বিক্রেতাদের হাঁক ডাক । আউট হাউস রহস্যের যবনিকা ছেপে বের করেছে সব কাগজই। গত রাত্রে শোপিয়াতে পুলিশ অধীক্ষকের অফিসে প্রেস মিটে তিনি জানিয়েছেন হত্যা হওয়া মানুষটি বিখ্যাত ব্যবসায়ী মিঃ বিনোদ কুমার ডাকুয়া নন । একজন যুবা আর্টিস্ট আসলাম বেগ । কাজেই ছাড়া পেয়েছেন সুদেশ বর্মন । পুলিশ জেনেছে যে বিনোদ কুমার ডাকুয়া ঘরে ফিরে এসেছেন । তিনি হঠাৎ প্রয়োজনে শ্রীনগর চলে আসেন কাউকে সংবাদ না দিয়ে , তাতেই গ্রামবাসীদের ধারণা হয় তিনি মৃত ।
পুলিশ আরো জানিয়েছে যে , জাহিদ গনাই বা জুনেইদ মাট্টু অথবা আবু বকর যে নামেই ডাকা হোক না কেন একজন ভয়ানক খুনী । আউট হাউসে যে লাশটি পাওয়া গিয়েছে সেটি পরীক্ষা করে সার্জেন জানিয়েছেন যে গলাটি ক্ষুর দিয়ে কাটা হয়েছে । এবং আউট হাউসের পোড়া ভগ্ন স্তুপে ক্ষুরটি পুলিশ খুঁজে পেয়েছে । এছাড়া একটি পুরানো লন্ঠনের পোড়া ফ্রেমও আবিষ্কৃত হয়েছে আউট হাউসে । মনে হয় এটাই আগুনের উৎস ছিল । তবে সবচেয়ে যেটা চমকে দেওয়া তথ্য সেটা হল অর্ধদগ্ধ মানুষটির পুড়ে যাওয়া মুখের কপালে পাওয়া একটা আবছা লাল ত্রিকোণ দাগ ! রঙটি পুড়ে নিঃশেষে নষ্ট না হওয়ায় তা সার্জেন সনাক্ত করতে সক্ষম হন ।
নিউজ পেপার থেকে মুখ নামিয়ে রেখে গোঁফ থেকে কফি মুছে ফেলে গুলফাম স্যার মন্তব্য করলেন ,
-- য়হ এক বাত হী বিনোদ ডাকুয়া কা বয়ান কী সত্যারোপন কে লিয়ে কাফী নহী হ্যায় ব্যানার্জি ?
-- ওহ তো হ্যায় । কিন্তু আফসোস এই যে আমাদের হাতে না জাহিদ গনাই , না জুনেইদ মাট্টু আর না আবু বকর এলো !
-- লেকিন লাল ত্রিকোণ কা থিওরী তো সাফ হুয়া ক্যা নহী ব্যানার্জি সাহাব ?
গুলফাম স্যারের উজ্জ্বল চোখের দিকে চেয়ে আমি কেবল মৃদু হাসলুম ।
আমাদের সামনে আজ ডাল লেকের জল সকালের সোনালী রোদের রঙ লেগে ঝলমল করছে । তিনজন মেয়ে শিকারা চালিকা ফুলের সম্ভার নিয়ে আসছে ঘাটের দিকে , যেন নতুন দিনের রঙীন সম্ভাষণ !
সমাপ্ত।
0 notes