আমি খ্রীস্টান না কিন্তু আমার প্রেয়সী খ্রীস্ট ধর্ম অবলম্বী। বাড়ি গেছে বহু ক্রোশ দূরে বড়দিন পালন করতে পরিবারের সাথে। আজ বড় ব্যস্ত গীর্জায় উৎসব পালন নিয়ে।
কোলকাতায় শুনশান নিঝুম ঘরে আমি একা। অপেক্ষা কেবল তার প্রত্যাবর্তনের।
জন্ম - মৃত্যুর চক্র থেকে আত্মা মুক্তি পায় কিনা জানিনা, যেমন জানিনা স্বর্গ - নরকের অস্তিত্ব কল্পনা ছাড়া আর কিছু কিনা। জন্মিলে মরিতে হবে কিন্তু মরণের পর পুনর্জন্ম বোধ হয় শোকাহত পরিবারের বৃথা আশা থেকে প্রসূত রূপকথা।
তবে ধর্ম মানুষকে সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে।
আমি বাঙালি। জন্মেছি হিন্দু পরিবারে। আমার আনন্দ হবে নাকি দুর্গা পুজোয়। হয় না।
প্রথাগত ধর্ম ত্যাগ করেছি বহুদিন হল। কিংবা কোনদিন ঠিক ভাবে মানি নি। কিন্তু বড়দিনের কেক - স্যান্টা টুপি, দুর্গা পুজোয় পাড়ার ঠাকুর দেখতে যাওয়া, রমজানে মুসলমান ধর্মালম্বী বন্ধুর হাতে হালিম আর ফিরনি খাওয়া - সবটাই করেছি। লিখতে লিখতে অনুভব করছি, উৎসবের সামাজিক পালন করতে দ্বিধা করিনি একটুও। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ!
মনের শান্তি খুঁজেছি ধর্মগ্রন্থে - সকল ধর্মের পবিত্র পুস্তকে। পাইনি কোথাও। ব্রহ্মের প্রতি বিশ্বাস নাড়া খায় বাস্তবের আঘাতে।
শিকড়ছাড়া, লক্ষ্মীছাড়া আমি এখন শূন্য।
জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়াই আমার আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান।
প্রেয়সী আমার পাহাড়ের কন্যা, প্রথমে সে নেমেছিল উপত্যকায় আর এখন সমভূমিতে। সে বিশ্বাস করে তার সাথে আমার আলাপ ছিল নিয়তি। ভাগ্যই তাকে এনেছে ঘর থেকে হাজার মাইল দূরে, আর যাযাবর আমি ফিরেছি ঘরে শুধু ভাগ্যের লিখন পূর্ন করতে। ভাগ্য আমি বিশ্বাস করিনা বহুকাল কিন্তু ক্ষণিকের জন্য রূপকথা ভালো লাগে।
চেটেপুটে ব্রেকফাস্ট খাওয়া, তার পরে কফি। এর মাঝেই ছোট্ট ছোট্ট দু চারটে কথা - একটু হাসি মজা, একটু মনে করা। তারপর যে যার ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কী প্যাডের ক্ষুদ্র অক্ষরগুলো আঙুলের ডগা দিয়ে টিপে টিপে লিখছি আমার মনের কথা।
আমি খুশি। সত্যি খুশি। তবে এ শুন্যতা কিসের? যেন কোন দরকারি কাজ করতে এসেছিলাম কিন্তু ভুলে গেছি সেটা কি, তাই ঘুরে বেরাচ্ছি পৃথিবীর বুকে উদ্দেশ্যহীন।
একটি অলস রবিবারের প্রারম্ভ করলাম আদি সংকরাচার্যের "মোহ মুদ্গর"-এর একাংশ পাঠ করে। ☺ মুঢ় জহীহি ধনাগমতৃষ্ণাম্ কুরু তনুবুদ্ধে মনসি বিতৃষ্ণাম্। যল্লভতে নিজকর্ম্মোপাত্তম্ বিত্তং তেন বিনোদয় চিত্তম্।।১।। হে মূঢ় জন কেবলমাত্র অর্থ উপার্জনের তৃষ্ণা পরিত্যাগ কর। এই ধরনের চিন্তা তোমার মনকে কেবলমাত্র জাগতিক করে দিয়ে মনে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে। তোমার উত্তম কর্ম্মের দ্বারা উপার্জিত যে অর্থ তোমাকে স্বচ্ছল রাখে তার দ্বারাই তোমার মনকে খুশী রাখো। কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ। কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভাতঃ।।২।। কে তোমার স্ত্রী? কেই বা তোমার সন্তান? এই সংসার হল অতীব বিচিত্র। তুমি কার? তুমি কোথা থেকে এসেছ? তত্ত্ব সহকারে এই বিষয়ে চিন্তা করে দেখ। মা কুরু ধনজনযৌবনগর্বম্ হরতি নিমেষাৎ কালঃ সর্ব্বম্। মায়াময়মিদমখিলং হিত্বা ব্রহ্মপদং প্রবিশাশু বিদিত্বা।।৩।। ধন, জন ও যৌবনের গর্ব না করাই ভাল কারন সময় এই সকলকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলে। এই অখিল জগতকে মায়াময় জেনে সেই পরম ব্রহ্মের চরণে আশ্রয় গ্রহন করাই তোমার পক্ষে ভালো। নলিনীদলগতজলমতিতরলং তদ্বজ্জীবনমতিশয়চপলং। ক্ষণমিহ সজ্জনসঙ্গতিরেকা ভবতি ভবার্ণবতরণে নৌকা।।৪।। পদ্মপাতার উপর জলবিন্দু যে রকম অস্থির, প্রাণীর মধ্যে প্রাণও সেই রকম অস্থির। তাই এই ক্ষণজীবনে যদি ক্ষণকালের জন্যও সাধুসঙ্গ লাভ করে থাকো তাহলে এই ভব সাগরে হতে সেই সাধু সঙ্গ নৌকা হয়ে তোমাকে পার করে দেবে। যাবজ্জনমং তাবন্মরনণং তাবজ্জননীজঠরে শয়নং। ইহ সংসারে স্ফূটতরদোষঃ কথমিহ মানব তব সন্তোষঃ।।৫।। প্রাক প্রসব অবস্থা, জন্ম, মৃত্যু এগুলি ক্রমাগত, এই সংসারের এই ক্ষণ ভঙ্গুর রূপ তুমি স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাও। তাহলে হে মানুষ তুমি কিসে সন্তুষ্ট থাকো? দিনযামিন্যৌ সায়ম্প্রাতঃ শিশিরবসন্তৌ পুনরায়াতঃ। কালঃ ক্রীড়তি গচ্ছত্যায়ুঃ তদপি ন মুঞ্চত্যাশাবায়ুঃ।।৬।। দিন-রাত্রি, সন্ধ্যা-সকাল, শীত-বসন্ত কতবার আসে কতবার চলে যায়, সময়ের এই খেলা দেখতে দেখতে আয়ু শেষ হয়ে যায় কিন্তু তবুও এই বায়ুর মত অফুরন্ত আশা মানুষের আর ফুরায় না। অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডম্ দন্ত-বিহীনং জাতং তুণ্ডম্। করধৃতকম্পিতশোভিতদণ্ডম্ তদপি ন মুঞ্চত্যাশাভাণ্ডম্।।৭।। অঙ্গ সকল কুঁচকে গিয়ে এমন হয় যেন গলে গলে পড়ছে, মাথা থেকে সব চুল উঠে যায়, দাঁত পড়ে গিয়ে মুখ বিবর চুপসে যায়, ঠুকরে ঠুকরে হাঁটে, হাতে ধরে থাকা লাঠিটাও যখন থর থর করে কাঁপতে থাকে তখনো মানুষ এই আশা নামক ফাঁকা মাটির হাঁড়িটা ছাড়তে চায় না। সুরবরমন্দিরতরুতলবাসঃ শয্যাভূতলমজিনং বাসঃ। সর্ব্বপরিগ্রহভোগত্যাগঃ কস্য সুখং ন করোতি বিরাগঃ।।৮।। সেই দেবতাদের মন্দির স্বরূপ তরুতলে যদি বাস করা হয়, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ কে শয্যা করা হয় এবং অজিন বসন যদি পরিধান করা হয় এবং সংসারের সকল ভোগে ত্যাগে আগ্রহ না রেখে সব কিছু পরিত্যাগ করে দেওয়ার এই বৈরাগ্যভাব কাকে না খুশি করে। জীবন দর্শন সত্যিই মনে অপার্থিব শান্তি এনে দেয়।
24.09.2017 - সুদীর্ঘ তিন মাস পর tumblr-এ আবার পোস্ট লিখছি। ইতিমধ্যে জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কর্মসূত্রে আমি বাড়ি থেকে 1814 কিলোমিটার দূরে! রাত পেরোলেই দূর্গা পঞ্চমী কিন্তু আমার ছুটি নেই; আমার উৎসব কাটবে কর্মব্যস্ততায়। কর্মই ধর্ম। (ছবিটি আমার কর্মস্থলের নিকটবর্তী বিমানবন্দরে অবতরণের আগে বিমান থেকে তোলা। সমুদ্রটি বঙ্গোপসাগর।)
রবীন্দ্র রচনাবলী কেবল সাহিত্যগ্রন্থ সমূহ নয়, আমার মতে সেটি দর্শনশাস্ত্র। তাই রবীন্দ্রনাথকে "পড়তে" হয় না, অনুধাবণ করতে হয়। তাঁর গল্প, উপন্যাস, কবিতা ব্যাখ্যা করে, তার উপর টীকা লিখে, ভাবসম্প্রসারণ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সাহিত্যের পিন্ডি চটকেছে (ভাষা মার্জনা করবেন) কিন্তু বছরের পর বছর এত পড়ে "পন্ডিত" হয়েও আমরা রবীন্দ্রভাবনা আত্মস্থ করতে পারিনি। আজ বাঙালি সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির আবর্জনার ভারে নুব্জ। রবীন্দ্রনাথ এখন "meme"-এর নতুন theme। এর জন্য দায়ী কে তার চুলচেরা বিচার করে কি লাভ? বিশ্বায়ন কে অবহেলা না করে, অপর জাতি ও তার সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা না করেও, উন্মুক্ত চিন্তাধারা পোষণ করেও নিজের ভাষা - ভাবনার ধারক ও বাহক হয়ে বিশ্ব দরবারে সম্মান অর্জন করা যায়। স্বয়ং কবিগুরু তাঁর জীবনের মাধ্যমে আমাদের সেই শিক্ষা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও তাঁর কীর্তি - দুই-ই অনুপ্রেরণার অমৃতভান্ডার। আমরা কেবল সেই অমৃতকে শো-কেসে বন্দি রেখে নিত্য বিষপাত্রে চুমুক দিচ্ছি। আজ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মতিথিতে ব্রহ্মের কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা - বঙ্গসন্তানদের সুমতি হোক। বাঙালির মঙ্গল হোক।
আজ প্রাতঃকালের চিন্তা - অন্যের দিকে কাদা ছুঁড়ে তাকে কর্দমাক্ত করা যায় না। একমাত্র পাঁকে নেমেই মানুষ পঙ্কিল হয়। আর কখনও কখনও কিছু জন তোমাকে পাঁকে টেনে নামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করবে। শত কষ্ট হলেও সেই সব মানুষদের নিজের জীবন থেকে বিদায় জানাতে হয়, নয়ত পাঁকের অতল তলে নিজেকে হারিয়ে যেতে হয়। কথায় বলে সব পরিস্থিতিরই বিকল্প হয়, কিন্তু কেউ বলেনা যে বিকল্পগুলিও সমান কঠিন হতে পারে। সিদ্ধান্ত তোমার।
আমরা বস্তুজগতের তাড়নায় মাঝে মাঝে বড় অবুঝ হই। তারই একটি উদাহরণ আজ প্রত্যক্ষ করলাম। ভারতবর্ষে আজ আর্থিক বর্ষপূরণ। কাজেই বিভিন্ন বস্তুসামগ্রী স্বাভাবিকের থেকে কম দামে বিক্রয় হচ্ছে বাজারে। খবরের কাগজে একটি বিজ্ঞাপণ দেখলাম সকালে - আমি ও আমার সহকর্মীরা। মোটর বাইক ক্রয়ের ক্ষেত্রে 25 - 50 হাজার টাকা ছাড়, মেক ও মডেলের উপর নির্��র করে। আমার এক সহকর্মী বেশ উৎসাহী হয়ে পড়েন। সমস্যা শুরু হয় তার পরে। উনি আমাকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন যে এই সুবাদে আমারও বাইক কেনা উচিৎ। আমি বাইক কিনতে আগ্রহী নই কতকগুলো কারণে -- - বাইক দূরে থাক, আমি সাইকেল চালাতেও জানি না। ভারসাম্য জ্ঞান আমার খুব কম। - কর্মক্ষেত্রের চত্বরেই আমার বাসস্থান। অতএব আমার প্রত্যহ ঘর বাহির হাঁটার মাধ্যমেই। - দৈনন্দিন নিত্য সামগ্রী কেনার জন্য বাজার অনতিদূরে, হাঁটা পথ। -সামান্য দূরে কোন কারণে যেতে হলে অটো পাওয়া যায়, মাত্র দশ টাকা ভাড়ায়। গাড়ির প্রয়োজন আপাততঃ নেই বললেই চলে। ��হকর্মী বন্ধুটিকে এ কথা বললাম। উত্তরে উনি আমায় বললেন, "এমন সুযোগ হাতছাড়া কোরো না। কিনে তো রেখে দাও!" যে জিনিসটার কোন প্রয়োজন বর্তমানে আমার নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে হবে না, নিছক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে বলে সেটা কিনে নেওয়া কি আদৌ বিবেচনাপূর্ণ? আমরা অপ্রয়োজনীয় কত বস্তু বৃথাভাবে প্রলুব্ধ হয়ে কিনে ফেলি, তা হিসাবের অতীত।